বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০ ২৪
এস ডি সুব্রত::
২২ নভেম্বর ২০ ২১
৭:৩০ অপরাহ্ণ

প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর: এস ডি সুব্রত

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস আলালের ঘরের দুলাল রচয়িতা প্যারীচাঁদ মিত্র জন্মগ্রহন করেন্ ২২শে জুলাই, ১৮১৪ এবং মৃত্যু বরন করেন ২৩শে নভেম্বর, ১৮৮৩ সালে। তার বাবার নাম রামনারায়ন মিত্র ছিলেন হুন্ডি ব্যবসায়ী ‌ । প্যারীচাঁদ মিত্রের পারিবারিক অবস্থা ছিল স্বচছল । তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক যার ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর।তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন ১৮২৭ সালে।

সেখানে হেনরি ডিরোজিও নামের একজন অসাধারণ শিক্ষকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।১৮৩৬ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে।ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। প্যারীচাঁদ ছিলেন সমাজহিতৈষীও সংস্কৃতিসেবী। বাঙালি সমাজের কল্যাণে তিনি বহু সংগঠন গড়ে তোলেন। জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ডেভিড হেয়ার মেমোরিয়াল সোসাইটি, রেস ক্লাব, এগ্রিকাল -চারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি, বেথুন সোসাইটির সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।১৮৫৭ সালে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস 'আলালের ঘরের দুলাল'। এটি বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত।

এই উপন্যাসে তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, পরে তা 'আলালী ভাষা' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বলা হয়ে থাকে যে, এই উপন্যাসে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতির নিয়ম ভেঙে চলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করেন।উপন্যাসটিতে তিনি ব্যবহার করেন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। উপন্যাসটি 'দি স্পয়েল্ড চাইল্ড' নামে ইংরেজিতেও অনূদিত হয়। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর ‘ইয়ংবেঙ্গল’দের সমকালে বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। প্যারীচাঁদ মিত্র এমন এক সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যখন প্রগতি- শীল চিন্তা, উদার মানবতাবাদী দর্শন, ব্রাহ্ম ধর্ম-আন্দোলন এবং নাস্তিকতার পাশাপাশি রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের দাপট, সামাজিক অসংগতি ও সনাতন মূল্যচেতনার যুগলস্রোতে বাংলাদেশের সমাজ ছিল পরিবর্তশীল। হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর সংস্পর্শে তাঁর মনে উদার মানবতাবাদী চেতনা ও মুক্ত-জীবনদৃষ্টির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল প্রথম থেকেই ‌।সহকর্মী ছিলেন উনিশ শতকের আরেক আলোকিত মানুষ রামতনু লাহিড়ী। শিক্ষা, সমাজ ও ব্যবসা নানা বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিতে সাব-লাইব্রেরিয়ান পদে যোগ দেন প্যারীচাঁদ।

১৮৩৯ সাল থেকে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েন। বস্ত্তত, বিদ্যা ও বিত্তের সাধনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ প্যারীচাঁদ মিত্র।ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিতে কর্মনিষ্ঠার জন্য তিনি লাভ করেন আজীবন কিউরেটর ও কাউন্সিলরের পদ। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ছেলেদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্যারীচাঁদ মিত্র অ্যান্ড সন্স’ নামের একটি কোম্পানি। উনিশ শতকে কলকাতায় প্যারীচাঁদ ছিলেন গতিশীল এক আলোকিত মানুষ। নানা কর্ম ও আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ সংযোগ। ১৮৩৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য সোসাইটি ফর দি একুইজিশন অব জেনারেল নলেজ’ নামে জ্ঞানচর্চার ব্যতিক্রমী এক প্রতিষ্ঠান। প্যারীচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী এই প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৮৬০ সালে স্ত্রী বামাকালীর মৃত্যুর পর প্যারীচাঁদ প্রেততত্ত্ব তথা থিওসফির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। গড়ে তোলেন থিওসফিক্যাল সোসাইটি। দেশি-বিদেশি বহু থিওসফিক্যাল সংস্থার সঙ্গে প্যারীচাঁদের ছিল গভীর সম্পর্ক।

প্যারীচাঁদ বাংলা, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন৷ বিভিন্ন সমাজ কল্যাণকর কাজের সঙ্গে প্যারীচাঁদ আজীবন যুক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন৷ এছাড়া ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির সচিব পদে তিনি বেশ কিছু সময় ছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র মূলত জনকল্যাণের জন্যই কলম ধরেছিলেন । স্ত্রী সমাজের উন্নতিই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। প্যারীচাঁদ মিত্র যে সমস্ত প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কৃষিপাঠ (১৮৬১), যৎ কিঞ্চিৎ( ১৮৬৫), ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত(১৮৭৮)। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনা জন্য প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসটি প্রথমেই বই হিসেবে প্রকাশ পায়নি। ১৮৫৭ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র এবং রাধানাথ শিকদার সম্মিলিতভাবে একটি মাসিক পত্রিকা শুরু করেছিলেন যেখানে সর্বসাধারণের জন্য সহজ সরল ভাষায় লেখা হত৷

এখানেই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আলালের ঘরে দুলাল’। প্যারীচাঁদ মিত্র সেই সময়কার সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে গুরুগম্ভীর সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাষায় ফারসি শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার দেখা যায়৷ ভুল ত্রুটি সত্ত্বেও বাংলা গদ্য কে সহজ করে তোলার চেষ্টায় তাঁর অবদান ছিল। প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা অন্যতম ব্যঙ্গাত্মক গদ্য রচনা হল, ” মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়”(১৮৫৯)। এছাড়া তিনি কথোপকথন ও গল্প মূলক রচনা লিখেছেন, যেমন “রামারঞ্জিকা” (১৮৬০), “আধ্যাত্বিকা ” (১৮৮০), “বামাতোষিণী” ( ১৮৮১) ইত্যাদি।"অভেদী” ও “আধ্যাত্বিকা” তে মানবতার স্বরূপ ও ঈশ্বর মহিমার কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ অন্যদিকে ” রামারঞ্জিকা” গ্রন্থটিতে সংলাপময় কুড়িটি অধ্যায় রয়েছে৷ ” যৎ কিঞ্চিৎ” ঈশ্বর তথ্যমূলক একটি দার্শনিক প্রবন্ধ গ্রন্থ৷ তিনি বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তন করলেও প্রবন্ধগুলি সাধু ভাষায় লিখেছেন। লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ। ০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ । subratadassulla@gmail.com

ফেইসবুক কমেন্ট অপশন
এই বিভাগের আরো খবর
পুরাতন খবর খুঁজতে নিচে ক্লিক করুন


আমাদের ফেসবুক পেইজ