সোমবার, ডিসেম্বর ২২, ২০ ২৫
শেখ আব্দুর রশিদ::
১৫ ডিসেম্বর ২০ ২৫
২:১৯ অপরাহ্ণ

জীবনের আলো আঁধার: ভেঙে পড়া মানুষের নিজেকে আবিষ্কার
নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন—মানুষকে টিকিয়ে রাখে সেই প্রয়োজনের টানই। যেমন ক্ষুধার্ত বাঘ খাবারের প্রয়োজনে ঝোপে লুকিয়ে থাকে। সামনে হরিণ দেখলে সেটি স্বভাবতই লাফ দেয়। হরিণ আবার নিজের সতর্কতার জোরে পালাতে চেষ্টা করে। এক লাফে হরিণ যায় প্রায় ২৫ ফুট, বাঘ যায় ২০ ফুট। এই হিসাবে ১০০ লাফের পরে হরিণ তো বাঘের চেয়ে অনেকটাই সামনে থাকার কথা।

তবু বাস্তবে শেষ মুহূর্তে বাঘই প্রায়শই জেতে। তার প্রধান কারণ হরিণের গতি নয়, তার মনোযোগ। হরিণ দৌড়াতে দৌড়াতে বারবার পিছনের দিকে তাকায় বাঘ কতটা কাছে এলো তা দেখার জন্য। এই পিছন ফিরে তাকানো তার লাফের গতি কমিয়ে দেয়। আর ঠিক সেই সুযোগেই বাঘ তাকে ধরে ফেলে।

অর্থাৎ হরিণের নিজের বাঁচার শিক্ষা, তার স্বাভাবিক দক্ষতা—সবই হারিয়ে যায় কারণ সে অন্যের দিকে তাকায়।
মানুষের ক্ষেত্রেও এমনই। মানুষ কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, পারিবারিক শিক্ষা পায়, দক্ষতা অর্জন করে। কিন্তু প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা, অন্যকে দেখে তুলনা করা—এসব কারণে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে তার শিক্ষা বাস্তবে কাজে লাগে না।

কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি জরিপে দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থীই জানে না তাদের জীবনের লক্ষ্য কী। শিক্ষা আছে, কিন্তু দিশা নেই। লক্ষ্য নেই। মনোযোগ নেই।

ঠিক হরিণের মতই, যার পায়ে গতি আছে, লাফে দক্ষতা আছে, তবুও কেবল পিছনে তাকানোর অভ্যাস তার বাঁচার শক্তিকে কাজে লাগাতে দেয় না।


ঢাকা থেকে লামা: একটি যাত্রা এবং ভাঙা মনকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা

২০০৩ সালের কথা। একজন নারী—বয়স সত্তরের কাছাকাছি—গত ষোলো বছর ধরে কান্নার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিলেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের শ্রদ্ধেয় গুরুজি আমাকে বললেন তাকে নিয়ে কোয়ান্টাম ধ্যানকেন্দ্র লামায় যেতে। আমরা ছোট দলটি ঢাকা থেকে বান্দরবানের পথে রওনা দিলাম।

গাড়িতে উঠে তিনি কান্না থামাতে পারছিলেন না। জানালেন, জীবনে এই প্রথম তিনি ঢাকা থেকে বাই রোডে কোথাও যাচ্ছেন। সারা জীবন ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাজশাহী, সিলেট—সব জায়গায়ই বিমানে ভ্রমণ করেছেন।

তারপর তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখটি বলতে শুরু করলেন। ষোলো বছর আগে তার একমাত্র ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়ে অতিরিক্ত মদ্যপানে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছেলেকে আনতে যান, কিন্তু ডাক্তাররা জানান যে,ছেলের অবস্থা গুরুতর। এভাবে ঢাকা আনা যাবে না। শেষ পর্যন্ত ছেলেটি সেখানেই মারা যায়।

ছেলেটির বয়স ছিল তেত্রিশ। শিক্ষিত, পরিপাটি, প্রতিশ্রুতিশীল একজন মানুষ। সেই ঘটনা থেকে তিনি ভেঙে পড়েন।

তিনি জানালেন, তার তিনটি বাড়ি—শান্তিনগরে, গুলশানে এবং ধানমন্ডির কাছাকাছি। একটি মেয়েও আছে, আছে নাতনিও। কিন্তু উচ্চশিক্ষা, সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা—কিছুই তাকে ও সেই বিরহের ব্যথা থেকে মুক্ত করতে পারেনি।
এটাই প্রমাণ করে, ভুল শিক্ষা মানুষকে জীবন সামলাতে শেখাতে পারে না। বাহ্যিক শিক্ষা থাকলেও যদি মানসিক শক্তি, ভেতরের স্থিরতা না থাকে তবে মানুষ ভেঙে পড়ে।

লামায় পৌঁছে আমরা তিনদিন থাকলাম। তিনি প্রতিদিন দুই বেলা করে ধ্যান করলেন। প্রথম দিন কান্না থামছিল না। দ্বিতীয় দিন তিনি অনেকটা চুপচাপ ছিলেন। তৃতীয় দিনের শেষে তার চোখে শান্তির ছাপ দেখা গেল।


১৬ বছরের কান্নার পর শান্তির অনুভূতি

ফিরতি যাত্রার সময় জিপে উঠেই তিনি বললেন, “আমি আর কাঁদব না।”
তিনি শান্ত ভাবে বললেন, “আমি বুঝেছি।”

এই পরিবর্তন ছিল অবিশ্বাস্য। যেন দীর্ঘ বোঝা নামিয়ে রেখেছেন।

তিনদিনের মধ্যে তিনি বুঝলেন, আসল শিক্ষা হলো যেটা মানুষকে নিজের ভেতরের শক্তির সাথে যুক্ত করে। যা তাকে সত্য মেনে নিতে শেখায়, স্থির করে, ঈর্ষা বা তুলনা থেকে দূরে রাখে, মানুষের মনকে সঠিক দিকে ফিরিয়ে দেয়।

আমার নিজের জীবনে বড় শিক্ষা

ওই যাত্রা আমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছিল।

পৃথিবীর সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী—মানুষ, সম্পর্ক, সম্পদ, সুখ, দুঃখ—সবই একসময় বদলে যায়।
এগুলোকে অতিরিক্ত আঁকড়ে ধরলে মানুষ ভেঙে যায়।
কিন্তু যারা দৃষ্টি ঠিক জায়গায় রাখে, যারা আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, যারা গুরুমুখী শিক্ষা, সংঘের সঙ্গ ও ধ্যানের মতো চর্চা ধরে রাখে, তারা শান্ত থাকে।

ওই মহিলা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, সম্পদও ছিল, কিন্তু তার শিক্ষা তাকে সামলাতে শেখায়নি।
কারণ শিক্ষা তখনই মূল্যবান যখন তা মানুষকে সঠিক পথে রাখে।

শেষ কথা

বাঘ–হরিণের গল্প তাই সহজ নয়।
গতি বা দক্ষতা নয়, মনোযোগই ঠিক করে দেয় কে টিকে থাকবে।
হরিণ পিছনে তাকানোর অভ্যাসে নিজের দক্ষতা হারিয়ে ফেলে।

মানুষও তেমনই—যদি সে অন্যকে দেখে তুলনা করতে ব্যস্ত থাকে, নিজের দক্ষতা কাজে লাগাতে না পারে, তবে শিক্ষিত হলেও সে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না।

লামার সেই যাত্রা আমাকে বুঝিয়েছে—শান্তি আসে তখনই যখন দৃষ্টি ঠিক স্থানে থাকে, আল্লাহর দিকে থাকে।
সম্পদ, সম্পর্ক, সাফল্য—সব ক্ষণস্থায়ী; স্থায়ী কেবল আল্লাহর সান্নিধ্য এবং সঠিক দৃষ্টি।

যে এই সত্য উপলব্ধি করতে পারে, সে-ই নিজের জীবনের পথ পরিষ্কার দেখতে পায়।

লেখক: শেখ আব্দুর রশিদ 
বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, লতিফা শফি চৌধুরী মহিলা কলেজ  

চেয়ারম্যান :সিলেট সেন্টার ফর ইনফরমেশন এন্ড ম্যাস মিডিয়া (সিফডিয়া)
ফেইসবুক কমেন্ট অপশন
এই বিভাগের আরো খবর
পুরাতন খবর খুঁজতে নিচে ক্লিক করুন


আমাদের ফেসবুক পেইজ