৩:২৪ অপরাহ্ণ

অর্থনীতিতে নারীর অবদান : পেশাদার চাকুরীতে বাড়াতে হবে নারীর অংশগ্রহণ
৮ মার্চ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হয় । ২০২৫ সালে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা উপায়ে নারীরা অবদান রেখেছে, বিশেষ করে নারী তার শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে।
গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশে নারী পোশাক শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য, তবে পোশাক শিল্প ছাড়াও কৃষি কিংবা সেবা খাত, বিশেষ করে খামারবহির্ভূত কৃষি কিংবা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে নারী শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যদিও সে অবদানের বিষয় খুব একটা আলোচিত হতে আমরা দেখি না। তবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কেননা, অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্রে নারীর অবদান, যা কিনা অর্থনীতি কিংবা সামাজিক মানদণ্ডের বিচারেও অস্বীকৃত ও অপ্রদর্শিত।
সাম্প্রতিক সময়ে গৃহস্থালি ও সেবাকাজে নারীর অবদানের বিষয়টিকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ-জাতীয় কাজকে গুরুত্বহীন ও অর্থনৈতিকভাবে অর্থবহ হিসেবে কখনোই বিবেচনা করা হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ-২২ এর তথ্য অনুযায়ী , ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে ৫৭ লাখ দেশের নারী কর্মে যুক্ত হয়েছেন। ২০২৪ সালে দুই কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার নারী কর্মজীবী হিসেবে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন।
শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৪২.৭৭ শতাংশ। শ্রমবাজারে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণের হার শহরের নারীর তুলনায় বেশি। পোশাক খাত ছাড়াও এখন হোটেল, রেস্তোরাঁ, যোগাযোগ খাত, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং ও বীমা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেশের বাইরে থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়েও অর্থনৈতিক সংকটে হাল ধরেছেন নারীরা। বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, ৩০ বছরের কম বয়সী প্রায় এক কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার নারী শ্রমশক্তিতে যুক্ত রয়েছেন, যা কর্মে নিয়োজিত নারীর অর্ধেকের বেশি।
এর মধ্যে এক কোটি ১৫ লাখ ৭৩ হাজার নারী গ্রামের। তবে সব ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী বেতন কিছুটা কম পান। জরিপে দেশে পুরুষের গড় আয় দেখানো হয়েছে ১৪ হাজার ১৮০ টাকা। নারীর গড় আয় ১১ হাজার ৯৩ টাকা। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে প্রায় চার লাখ নারী কর্মী প্রবাসে গেছেন। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রতিবছর নারীরা সৌদি আরব, জর্দান, কাতার, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাচ্ছেন।
কৃষি খাতেও নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষিকাজে নিয়োজিত। আশার কথা হচ্ছে, প্রবাস আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। আর এই অবস্থানে নিয়ে যেতে দেশের নারী শ্রমিকরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে তিন লাখ মানুষ অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এর অর্ধেকই নারী ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা। এসব উদ্যোক্তা নিজ নিজ পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মাসে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন।
ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের বড় পেজ উইমেন অ্যান্ড ই-মার্স ফোরাম (উই) ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এই পেজের সদস্যসংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। শুধু করোনাকালে প্রায় ১০ লাখ নারী উদ্যোক্তা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন। কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এখনো দেশে নারী-পুরুষের বেতনবৈষম্য রয়েছে। নারীর জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশের চ্যালেঞ্জ ছাড়াও কর্মজীবী মায়ের সন্তানের জন্য ডে কেয়ার সুবিধা খুব সীমিত। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। আর পোশাক খাতের এই অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে নারী শ্রমিকদের কারণেই।
বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা রাখছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বৈশ্বিক রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ ক্রমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সূচক বলছে, বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এই সমতা নারীর অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী।
তাই নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পাচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক উন্নতির কারণে আগের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণও বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ যখন একই পদবিতে কাজ করেন, তখন নারী-পুরুষের আয়ের বৈষম্য কমে আসে। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এখনো সব ধরনের কাজে নারীর অংশ নেওয়া হচ্ছে না। এখনো নির্দিষ্ট কিছু গতবাধা কাজেই নারীকে দেখা যাচ্ছে। তবে চাকরির বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এখনো নারীকে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। এমনটি হচ্ছে উচ্চতর শিক্ষায় নারীরা পুরুষের তুলনায় এখনো পিছিয়ে আছে বলে।
এ জন্য পেশাদার চাকরিগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো কম। দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে নারী ও পুরুষের অবস্থা ও অবস্থানের ব্যবধান দ্রুতই কমিয়ে আনতে হবে। দিন যত যাচ্ছে দেশে ই-কমার্স ও এফ কমার্স ব্যবসায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি বলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মীরা। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, ই-কর্মাস খাতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ২৫ শতাংশ। এ খাতের বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বাজার নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে। নারী এখন আর কেবল গৃহস্থলীর কাজে সীমাবদ্ধ নয়। চাকরি ও ব্যবসায় পুরুষের পাশাপাশি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের হিসেবে, ই–কর্মাস খাতে নারী উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ প্রায় ২৫ শতাংশ। তবে ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসায় নারীরা অনেক এগিয়ে। অনলাইন বেচাবিক্রির ৫ লাখ ফেসবুক পেজে ৫৫ ভাগই নারী উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সন্তান মেয়ে হলে উচ্চশিক্ষা নাকি তার বিয়ের জন্য বিয়ের জন্য অর্থ ব্যয় করব। এই যে স্বাধীনতা, এটা মেয়েদের নাই এখনো। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, উন্নয়নের সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য দূর করতে নারী পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা জরুরি।পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো।
এমনকি পাকিস্তানের চেয়ে বেশ এগিয়ে। তবে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। এখনো কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৪০ শতাংশের নিচে। বেশির ভাগ নারী এখন পড়াশোনা করলেও কর্মসংস্থানে আসছে না। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তাদের পিছিয়ে রাখছে। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ বড় ক্ষতি করছে।’ তিনি বলেন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারলে নারীদের স্বাধীন করা সম্ভব হবে। পরিবার বহির্মুখী ও সচ্ছল হবে।
এ জন্য সনাতনি সমাজব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখনো নারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে সরকারের দিক থেকে ভালোভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পোশাক খাতের বাইরে বেসরকারি খাতে এখন প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। এ বিষয়ে আরো অনেক কাজ করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করে নারীর স্বাধীনতা বাড়াতে হবে। নারীর কর্মক্ষেত্র করতে হবে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে কাংখিত লক্ষ্যে ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ। নিলয় ১৭৪/৩ পূর্ব নতুন পাড়া, সুনামগঞ্জ। ০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ sdsubrata2022@gmail.com