বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ১০ , ২০ ২৪
নাজমুল ইসলাম,কুলাউড়া ::
৭ সেপ্টেম্বর ২০ ২৪
২:৪১ অপরাহ্ণ

বিএসএফ এর নির্মমতার বলি স্বর্ণার পরিবারে থামছে না কান্না-শোকস্তব্ধ জুড়ী
‘মা তোমার প্রাণ রক্ষা করো,আমি বাঁচব না’

কুলাউড়া উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের লালারচক সীমান্তের পাশে জলাশয়ে পৌঁছামাত্র হঠাৎ বিএসএফকে দেখে স্বর্ণা, আতংকিত হয়ে অনুনয়-বিনয় করে বলে আমাদের মেরোনা আইনের আশ্রয়ে নিয়ে নাও।

বাংলায় বলা কথাগুলোর প্রতি উত্তরের বদলে বিএসএফ এর বুলেটে বুক ঝাঁজরা হয়ে যায় স্কুল ছাত্রী স্বর্ণার।

বিএসএফ’র রাইফেল তাক করানো দেখে স্বর্ণা ভয়ে কাঁটা তার থেকে ঘুরে বাংলাদেশের দিকে দৌড় দেয়। ঠিক তখনই পেছন থেকে বিএসএফ’র ছুড়া গুলি তার পিটের পেছন দিকে ঢুকে বুকের সামনের ডানপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।

বাঁচার জন্য মা সঞ্জিতা রাতের আধাঁরে গুলিবিদ্ধ মেয়ের হাত ধরে টেনে কিছু জায়গা নিয়ে আসেন,তখনই স্বর্ণা বলে, ‘মা হাতটা ছেড়ে দাও, আমি আর বাঁচব না’।

তোমার প্রাণ রক্ষা করো। কি নির্মম পরিহাস চোখের সামনে কলিজার টুকরো আদরের মেয়েকে কাঁটাতারের পাশে জলাশয়ে ফেলে আসতে বাধ্য হন। স্বর্ণার ভাই পিন্টু দাস এমনিভাবে কান্না জড়িত কণ্ঠে এসব কথা জানায়।

মায়ের জ্ঞান ফেরার পর তার কাছ থেকে এ হৃদয় বিদারক ঘটনার বর্ণনা শুনেছে পিন্টু। স্কুল ছাত্রীর স্বর্ণার মর্মান্তিক মৃত্যুতে মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার কালনীগড় গ্রাম এখন শোকেস্তব্ধ। শান্ত এই জনপদ শোকে আরো কাতর হয়ে গেছে।

এই গ্রামেরই কিশোরী প্রাণচঞ্চল স্বর্ণা দাস চলে গেছে পরপারে। সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে বিএসএফ এর বুলেটের আঘাতে প্রাণ গেছে স্বর্ণার। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ এর নির্মমতার বলি স্বর্ণার পরিবারে থামছে না কান্না। বাবা পরেন্দ্র দাস ও মা সঞ্জিতা রানী দাস বার-বার মুর্ছা যাচ্ছেন।

৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে স্বর্ণা ছিলো সবার ছোট। পড়ালেখায় ছিলো মেধাবী। পুরো স্কুল মাতিয়ে রাখতো। সহপাঠিরা অকালে স্বর্ণাকে হারানোর শোকে মুহ্যমান। নিরোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেনীর ছাত্রী স্বর্ণা মায়ের সাথে গত ১ সেপ্টেম্বর রোববার রাতে কুলাউড়ার শরিফপুর ইউনিয়নের লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারত যেতে চেয়েছিলো।

ত্রিপুরা রাজ্যের শনিচড়া গ্রামে তার মামার বাড়ি। স্বর্ণার এক ভাই মামা কার্তিক দাসের পরিবারের সাথে দীর্ঘদিন থেকে আছে। ভাইকে দেখা ও মামার বাড়ি বেড়ানো অধরাই রয়ে গেলো স্বর্ণার। স্বর্ণা দাসের বাবা পরেন্দ্র দাস বলেন, রোববার সকালে মা ও মেয়ে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন।

সোমবার সকালে স্বর্ণার মামার বাড়িতে যোগাযোগ করে জানতে পারি তারা যায়নি। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক সেনা কর্মকর্তার সহযোগিতায় শমশেরনগর থেকে স্বর্ণার মাকে উদ্ধার করি। পরদিন সোমবার বিকেলে বিজিবির মাধ্যমে আমার মেয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই।

স্বর্ণার মা সঞ্জিতা রানী দাস বলেন, সীমান্ত এলাকায় আমি ও আমার মেয়ে দালালদের খপ্পরে পড়ে যাই। সাথে চট্রগ্রামের আরো একটি পরিবার ছিলো তারাও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সীমান্তের কাছে যাওয়া মাত্রই হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।

নির্দয় বিএসএফ এর গুলিতে আমার মেয়ের শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেছে। এ কথা বলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সঞ্জিতা রানী দাস। স্বর্ণার সহপাঠি সুস্মিতা পূর্বা, বর্ণা ও সিপা জানায়, পড়ালেখায় সে ভালো ছিলো। খেলাধুলাও করতো। পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখতো। বন্ধু রাষ্ট্রের এই বাহিনী এতো নির্মম কেনো? গুলি করতে তাদের বুক একবারও কাঁপলো না।

স্থানীয় পশ্চিম জুড়ী ইউপির ১নং ওয়ার্ডের সদস্য মদন মোহন দাস বলেন, মেয়েটি বড় ন¤্র ভদ্র ছিলো। পুরো গ্রামেই তার সুনাম ছিলো। পশ্চিশ জুড়ী ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, গুলি করে মারার অধিকার কে দিলো। আমরা সীমান্তে গুলি করে মারাকে সমর্থন করি না।

আর কত ফেলানির মতো লাশ সীমান্তে পড়বে। ভারত যদি আমাদেও বন্ধু ভাবে তাহলে এসব বন্ধ করতে হবে। স্বর্ণার মৃত্যুর ৪৫ ঘন্টা পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে স্বর্ণার লাশ হস্তান্তর করে বিএসএফ। পরদিন বুধবার তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।

এদিকে বিএসএফের গুলিতে স্বর্ণা দাস নামের ১৪ বছর বয়সী কিশোরীকে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) এ বিষয়ে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনকে একটি প্রতিবাদ নোট পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠানো ওই প্রতিবাদ নোটে এ ধরনের নির্মম কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

সেই সঙ্গে এসব ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারকে জানিয়েছে, সীমান্ত হত্যার এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অযৌক্তিক।

পাশাপাশি এ ধরনের পদক্ষেপ সীমান্ত কর্তৃপক্ষের জন্য যৌথ ভারত-বাংলাদেশ নির্দেশিকা, ১৯৭৫ এর বিধান লঙ্ঘন করে।

প্রতিবাদ নোটে ভারত সরকারকে এ ধরনের জঘন্য কাজের পুনরাবৃত্তি বন্ধের পাশাপাশি সীমান্ত হত্যাকা-ের তদন্ত পরিচালনাসহ ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।

ফেইসবুক কমেন্ট অপশন
এই বিভাগের আরো খবর
পুরাতন খবর খুঁজতে নিচে ক্লিক করুন


আমাদের ফেসবুক পেইজ