৫:০ ৪ পূর্বাহ্ণ

আরেক আতংক পঙ্গপাল--এস ডি সুব্রত
মহামারী নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ যখন ভয়াবহ আতঙ্ক রুপে বিরাজ করছে এরই মধ্যে আবার শূরু হয়েছে ঘাস ফড়িং এর সমগোত্রীয় পতঙ্গ পঙ্গপালের তান্ডব।২০১৯ সালের শেষ দিকে আফ্রিকায় পঙ্গপালের ভয়াবহ আক্রমণে উদ্বেগজনক হারে ফসল ধ্বংস হয়েছে। সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ায় প্রায় ৯২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ধ্বংস করে এই পঙ্গপাল।পরে জিবুতি ও ইথিওপিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। মিসর , ইয়েমেন, সৌদি আরব ও ইরানের ছড়িয়ে পড়ে ।পাকিস্তানে পঙ্গপালের আক্রমণ শুরু হয় ২০২০ সালের প্রথম দিকে।এটি দক্ষিণ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে লাখ লাখ হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ ,মধ্য প্রদেশ, পাঞ্জাব সহ একাধিক রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে পঙ্গপাল।
পাকিস্তান ও ভারতের পর এটি বাংলাদেশেও আক্রমণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছে। আগামী বছর এরা বাংলাদেশে আক্রমন করতে পারে। বাংলাদেশও পঙ্গপালের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাতাসের গতি অনুযায়ী এরা চলাফেরা করে।এক জায়গায় খাবার শেষ করে নতুন জায়গায় যায়।
পঙ্গপাল মুলত এক প্রকার পতঙ্গ ।এটা আর্কিডিয় পরিবারের ছোট শিং বিশিষ্ট বিশেষ প্রজাতির যাদের জীবনচক্রে দল বাঁধার পর্যায় থাকে। এরা সাধারণত একা থাকে। তবে বিশেষ অবস্থায় এরা একত্রে জড়ো হয়।তখন এদের আচরন ও অভ্যাস পরিবর্তিত হয় সঙ্গলিপ্সু হয়ে পড়ে। পঙ্গপাল ও ঘাস ফড়িং এর মধ্যে পার্থক্য গত শ্রেণীবিন্যাস নেই বিশেষ অবস্থায় তাদের প্রজাতিগুলোর পরিবর্তিত হওয়ায় যে আলাদা প্রবনতা দেখা যায় সেটাই মূলত পার্থক্য।
পঙ্গপালের ইতিহাস খুব পুরোনো। প্রাচীন মিশরীয়দের কবরে পঙ্গপালের ছবি দেখা যায়। গ্রীসের ইলিয়াডে পঙ্গপালের উল্লেখ রয়েছে। বাইবেল ও কোরআনের মতো ধর্ম গ্রন্থেও পঙ্গপালের কথা উল্লেখ রয়েছে।
ধর্ম গ্রন্থে এই পতঙ্গকে ঈশ্বরের শাস্তি স্বরূপ বলা হয়েছে।
ইদানিং সময়ে এর উৎপত্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় গত বছর হর্ন অব আফ্রিকা তে স্বভাবিকের চেয়ে প্রায় চারশ গুন অধিক বৃষ্টিপাত হয়।ফলে ২০১৯ সালের শেষে এবং ২০২০ সালের শুরুতে পৃথিবীর অধিক অঞ্চলে এর ব্যাপক বংশবৃদ্ধি দেখা দেয়। নতুন ধরনের যে পঙ্গপাল এদের দশ লাখের একটি দল একদিনে ৩৬ হাজার মানুষের খাবার খেয়ে ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে পৃথিবীর প্রাণী জগতের মধ্যে এই পতঙ্গ বিস্ময়কর আচরন দেখাতে সক্ষম।আর্কিডিয় পরিবারের ছোট শিং এর বিশেষ এই প্রজাতি মুলত বিশাল ঝাঁক বেঁধে আক্রমন চালায়। এতে সাবাড় হয় মাঠের পর মাঠের ফসল। ঘাসফড়িং একলা বসবাস করে। পঙ্গপাল চলে দল বেঁধে।একক পঙ্গপাল কে বলা হয় লুকাস( locust) ।আর তাদের ঝাঁক কে বলা হয় লোকাস সোর্ম ( locust swarm) ।একা থাকাকালীন পঙ্গপাল তেমন ক্ষতিকর নয়। বিজ্ঞানীদের মতে পঙ্গপালের মস্তিষ্কের বিশেষ পরিবর্তনের কারণে দ্রুত বহুসংখ্যক সন্তান জন্ম দিতে পারে বা বংশবিস্তার করতে পারে। এভাবে এদের দল বড় হতে থাকে। এদের দল যখন অনেক বড় বড হয় তখন উড়ে বেড়াবার প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়।তখন দলটি খাদ্যের গন্ধ নিয়ে নতুন নতুন খাবারের সন্ধান করে। যতক্ষণ কোন অঞ্চলে খাদ্যশস্য আছে ততক্ষন ঐ অঞ্চলে অবস্থান করে।কোন অঞ্চলে খাদ্য শেষ হয়ে গেলে এরা সে অঞ্চল ত্যাগ করে।এই পতঙ্গের ডিম মাটিতে অনেক দিন টিকে থাকতে পারে।বিশ বছর পরেও এর ডিম থেকে বাচ্চা হতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে প্রাপ্ত বয়স্ক পঙ্গপাল নিজের ওজনের সমান খাবার খেয়ে ফেলতে পারে।মূলত বাতাসের গতিপথ অনুসরণের মাধ্যমে এরা এগিয়ে চলে । তাই বাতাস যেদিকে যায় এরা সেদিকে আক্রমন চালায়।পথে যেতে যেতে বিভিন্ন ঝাকের সাথে যুক্ত হয়ে এরা বড় ঝাঁক তৈরি করে।এগুলোর একটি বড় ঝাঁক ৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। প্রতি কিলোমিটারে ৪-৮ কোটি পতঙ্গ থাকতে পারে।
পঙ্গপালের আক্রমন ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি। প্রথম দিকে কীটনাশক ছিটিয়ে , যন্ত্রের সাহায্যে আগুনের হলকা দিয়ে ও জলাশয়ে ফাঁদ পেতে এর থেকে কিছু প্রতিকার পাওয়া যায়। তবে কীটনাশক ব্যবহারের কারনে অনেক উপকারী পতঙ্গের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে বলে এটা প্রয়োগে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে।
পঙ্গপালের উপদ্রব ঠেকাতে আজ পর্যন্ত তেমন কোন কার্যকর উপায় আবিষ্কৃত না হলে ও এদের আগুনে পুড়িয়ে মারবার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়ে থাকে। সাধারণত এদের গতিপথে আড়াআড়ি লম্বালম্বি ভাবে গভীর নালা কেটে রাখলে তাড়া খেয়ে এরা দলে দলে নালার মধ্যে স্তূপীকৃত হতে থাকে।তখন কেরোসিন প্রভৃতি পদার্থের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলে এরা মারা যায়।
অনেক ক্ষেত্রে গভীর গড়খাইয়ের মধ্যে মসৃণ টিনের পাত নালার মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়। পঙ্গপাল তার নীচে পড়ে গেলে টিনের মসৃন গা বেয়ে উপরে উঠতে পারে না।তখন এগুলোকে ক্রেনের সাহায্যে উপরে এনে বস্তাবন্দি করে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে পুড়িয়ে মারা যায়।