৭:৫৩ অপরাহ্ণ
নন্দিত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন
"এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয়না।” ( শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন) । জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমদ।
তিনি ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তার মায়ের নাম জয়নাবুন্নেছা। তার নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুর রামরঙ্গিনী এম.ই. স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করার পর, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
এই স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে নবম ভর্তি হন ময়মনসিংহ মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য যান। সেখান থেকে ঘুরে আসার পর পড়াশুনায় মন বসাতে পারছিলেন না কোনভাবেই।
এই কলেজের টানেই তিনি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুলাই কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। এই স্কুলে প্রথম বর্ষে ১৯৩২-৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর শিক্ষক ছিলেন বলাইচন্দ্র দাস। দ্বিতীয় বর্ষে ১৯৩৩-৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান রিসেন মিত্রকে। এই সময় তিনি যে সকল ছবি আঁকেন তাঁর কিছু নমুনা জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। এর ভিতরে 'শম্ভুগঞ্জ ঘাট' ও 'শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ' ছবি এঁকেছিলেন ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে। এই বৎসরের আরও দুটি ছিল শ্রমজীবী সাধরণ মানুষের ছবি।
তৃতীয় বর্ষে ১৯৩৪-৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর শিক্ষক ছিলেন মনীন্দ্রভূষণ গুপ্ত। এই বৎসরে তাঁর আঁকা দুটি ছবি জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। এর একটি মানুষের অন্যটি দৃশ্যপটের। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ বর্ষ ১৯৩৫-৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর শিক্ষক ছিলেন বসন্তকুমার গাঙ্গুলি। এই সময় শুরু হয় তাঁর ফাইন আর্ট পর্ব।
এই বৎসরে তাঁর আঁকা ১টি ছবি জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং নিখিল ভারত চিত্র প্রদর্শনীতে গভর্নরের স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের বাংলার দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি তাঁদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে দুর্ভিক্ষের যে মর্মান্তিক দৃশ্যাবলি দেখতে পান এবং ব্যথিত চিত্তে কলকাতায় ফিরে আসেন।
এই সময় দুর্ভিক্ষের স্কেচ করতে থাকেন। ওই বছরেই দুর্ভিক্ষ নিয়ে কলকাতায় তিনি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। তাঁর অঙ্কনের মূল বিষয়বস্তু ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ, যা ছিল তাঁর শিশুকাল অনুপ্রেরণার বিষয়। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, মই দেয়া, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি । ১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা মৃত তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমকে বিবাহ করেন। তিনি ৩ পুত্র সন্তানের জনক ।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্প আন্দোলনের পরিচালক ছিলেন। ময়মনসিংহ শহরের উত্তর পাশে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি দোতলা ঘর বাড়া করে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগ্রহশালায় প্রথমে স্থান পেয়েছিল ৭০ টি চিত্রকর্ম যার বেশিরভাগই ছিল জলরঙের।
উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি ছিল সেখানে যেগুলো হলো – বিভিন্ন দেশ ভ্রমনকালে শিল্পাচার্যের অঙ্কিত ছবি, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র এবং দুর্ভিক্ষ। সংগ্রহশালাটি ১৯৮২ সালে চুরি হয়ে ১৭ টি অতি আকর্ষণীয় ছবির খুঁজ পাওয়া যাচ্ছিল নাহ ,তবে ১০ টি ছবি ১৯৯৪ সালে আবার উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তাই সংগ্রহশালায় মোট ৬৩ টি চিত্রকর্ম রয়েছে এবং রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জিনিস এবং তার কিছু স্থিরচিত্র। স্থিরচিত্রগুলো ভবনের দোতলার বারান্দায় শোভা পায়।
নিজ উদ্যোগে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি পুরাতন কক্ষে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপিত করেন। প্রথমে ১৮ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে এই আর্ট ইন্সটিটিউট সেগুন বাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আর্ট ইন্সটিটিউটটি শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এটি একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর একই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’।চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, জয়নুল আবেদীন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ। পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারের আমৃত্যু প্রচেষ্টার চালিয়ে যান ,যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণ্যে তিনি শিল্পাচার্য উপাধি লাভ করেন।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ছবি চিত্রমালার জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা। তার দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অংকিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অংকিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। অনুমান করা হয় তার চিত্রকর্ম তিন হাজারেরও বেশি। পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারের আমৃত্যু প্রচেষ্টার চালিয়ে যান ,যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণ্যে তিনি শিল্পাচার্য উপাধি লাভ করেন।
বাংলাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরু হিসেবে পরিচিত। তার নামে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় এ চারুকলা অনুষদে একটি গ্যালারি রয়েছে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৫ সংখ্যক গ্যালারীটিতে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা হিসাবে সজ্জিত করে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ছবি চিত্রমালার জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা।
তার দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অংকিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অংকিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। অনুমান করা হয় তার চিত্রকর্ম তিন হাজারেরও বেশি। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৯ জুলাই, ২০০৯ বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ তার মানবসভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার প্রেক্ষিতে আবেদিন জ্বালামুখ নামে নামকরণ করা হয়। ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণে তিনি তাঁর সমস্ত কাজ সম্পন্ন করতে পারেন নি। তাঁর স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।
sdsubrata2022@gmail.com