সোমবার, সেপ্টেম্বর ৯, ২০ ২৪
এস ডি সুব্রত::
৯ আগস্ট ২০ ২৩
৮:১৯ অপরাহ্ণ

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস: আদিবাসীদের অর্জনের স্বীকৃতি

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রয়েছে আদিবাসী। একটি দেশের উন্নয়নে তাদের অবদান ও অর্জনকে স্বীকৃতি দিতেই জাতিসংঘ ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৪৫টিরও বেশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী)। আদিবাসীদের অধিকার আর জীবনমান রক্ষার পাশাপাশি সাংবিধানিকভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে পার্বত্য এলাকার বাসিন্দারা। এক তথ্যে জানা যায়, ঔপনিবেশিক সময়ে শতাব্দীকাল ধরে বৈষম্য-নিপীড়ন ও জাতিগত আগ্রাসনে ৭০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি আদিবাসীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।

বিলুপ্ত হয়ে যায় কোনো কোনো আদিবাসীর অস্তিত্ব। এ কারণে আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে আদিবাসী বর্ষ ও ১৯৯৪ সালে ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন অংশীদারিত্বে নিয়ে আসার জন্য ১৯৯৫-২০০৪ সালকে প্রথম আদিবাসী দশক ও ২০০৫-২০১৪ সালকে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি জাতিসংঘ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রও প্রণয়ন করেছে। কিন্তু সমতলসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের এখনো মেলেনি সাংবিধানিক স্বীকৃতি। অন্যদিকে আদিবাসী জনগণকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলা হয়েছে। আর এতে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে উদ্বেগ আর আতঙ্ক। এদিকে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় এবং সাংবিধানিকভাবে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করার জন্য বর্ণাঢ্য আয়োজনে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে। বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা এবং তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ ও চর্চাকে অব্যাহত রাখতে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদযাপনের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়। বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও তাদের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ার জন্য জাতিসংঘ ও আদিবাসী জাতি এক নতুন অংশীদারিত্ব ঘোষণা করে।

আদিবাসীদের অধিকার, মানবাধিকার ও স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিয়ে ১৯৮২ সালের ৯ আগস্ট জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনটিকে স্মরণ করার জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবহেলিত, সুযোগবঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের সমস্যাগুলোর ওপর মনোযোগ আকর্ষণ করা এবং তাদের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা।

এ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিকারবঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামে। দিবসটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য হলো আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনধারা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার ও তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা। বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও,গাইবান্ধা, বগুড়া ইত্যাদি জেলাগুলোতে সাঁওতাল, শিং (গঞ্জু), ওঁরাও, মুন্ডারি, বেদিয়া মাহাতো, রাজোয়ার, কর্মকার, তেলী, তুরী, ভুইমালী, কোল, কড়া, রাজবংশী, মাল পাহাড়িয়া, মাহালী ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং বা ম্রো, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া,বম, খুমী ও চাকগোষ্ঠী বসবাস করছে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধকোটি মানুষ।

সাংবিধানিক পরিভাষায় ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নাই’। এমনকি সাংবিধানিক কাঠামোতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনও জাতিসত্তার মানুষকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে স্বীকারই করে না, কেন না বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৬(২)-এ উল্লেখ আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’। অর্থাৎ বাঙালিরাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাঙালি ছাড়া ভিন্ন কোনও জাতির মানুষ (সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, ওরাং, মুন্ডা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রো প্রভৃতি) বাংলাদেশের নাগরিক নন। তবে, সংবিধানের আটিক্যাল ২৩-এ গিয়ে এসব জাতিগোষ্ঠীকে জাতি হিসাবে নয় বরঞ্চ ভিন্ন নামে এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

বাঙালি ছাড়া ভিন্ন জাতিসত্তার যেসব মানুষ বাংলাদেশে বাস করে তারা রাষ্ট্রের ভাষায় ‘বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, এবং সম্প্রদায়’ (বাংলাদেশ সংবিধান ২৩/ক) হিসাবে পরিচিত। অতএব, আজ যখন গোটা দুনিয়া বহুভাষাভাষী মানুষের এবং বহু সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের আদিবাসী মানুষদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালন করছে, তখন বাংলাদেশে তারা তাদের সাংবিধানিক এবং আইনি অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে।

নিজেদের আত্মপরিচয়ের এ সংকট আজকে নতুন নয়। একাত্তরে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই তারা তাদের আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ৬(২) ধারায় বাংলাদেশকে যেমন ‘বাঙালির দেশ’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘এদেশের নাগরিক বাঙালি বলিয়া গন্য হইবে’ বলে ‘অবাঙালি আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিকভাবে অস্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় বিগত চার দশকেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে সত্য কিন্তু ‘আদিবাসীদের’ স্বীকৃতি এবং অধিকার বিষয়ের রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কোনও পরিবর্তন হয়নি। এরকম একটি বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘের ‘আদিবাসীর অধিকার ঘোষণার একদশক’কে বিবেচনা করতে হবে।

অন্যথায় আদিবাসী সমাজের নিত্যদিনের বঞ্চনা, বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক অত্যাচার, ভূমি দখলের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা এবং রাষ্ট্রীয় ও ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় আদিবাসী মানুষের অসহায় ও কষ্টকর জীবনের কোনও আসল চেহারা আমরা দেখতে পাবো না। এখানে আরও মনে রাখার জরুরি যে, ‘আদিবাসীদের অধিকার ঘোষণার একদশক পূর্তি’ কেবল দশ বছরের হিসাবনিকাশ বিবেচনায় নিলেই হবে না। বিবেচনায় নিতে হবে দু’টি আদিবাসী দশক ও তার লক্ষ্যমাত্রা। জাতিসংঘের প্রথম আদিবাসী দশক ছিল ১৯৯৫-২০০৪ এবং দ্বিতীয় দশক ছিল ২০০৫-২০১৪। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রথম আদিবাসী দশকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে মানবাধিকার, পরিবেশ, প্রতিবেশ, উন্নয়ন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের যে সংকট ও সমস্যা আদিবাসী জনগোষ্ঠী মোবাবিলা করছিল তা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় আদিবাসী দশকের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল, সক্রিয়তা এবং সম্মান সুনিশ্চিত করণের জন্য অংশগ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত যাদের আমরা এখন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বলি তাদের ভূমি সমস্যা সমাধান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা না হয় বাদ দিলাম । তাঁরা ‘আদিবাসী’ হিসাবে নিজেদের এখনও স্বীকৃতি পর্যন্ত মেলেনি।

প্রতি বছর বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন আয়োজনে উদযাপিত হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এ দিবসটি শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার দিবস নয়, দেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সংগ্রামী জনসাধারণের অধিকার আদায়ের দিবসও বটে। লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ। ০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ sdsubrata2022@gmail.com

ফেইসবুক কমেন্ট অপশন
এই বিভাগের আরো খবর
পুরাতন খবর খুঁজতে নিচে ক্লিক করুন


আমাদের ফেসবুক পেইজ