৭:৩৮ অপরাহ্ণ
আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস: পরিবার হোক প্রবীণদের আসল ঠিকানা
এস ডি সুব্রত::পহেলা অক্টোবর,আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রতিবছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও এই দিবসটি পালন করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ৬০ বছর বয়সী মানুষকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৬০ বছর বয়সী প্রবীণ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। চলমান সহস্রাব্দে সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের বিষয় হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ২০৫০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আট থেকে বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছে। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের বা সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা হবে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ২০৩০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বা সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা দুইকোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি হবে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় পৃথিবীর সব দেশেই প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে এবং তাদের অসহায়ত্বও বৃদ্ধি পাবে।
প্রবীণদের বার্ধক্য, স্বাস্থ্য সমস্যা, কর্মঅক্ষমতা, পরিবার হতে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব ইত্যাদি বিষয় যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের কল্যাণের জন্য প্রবীণবিষয়ক নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ১৯৩৮ সালে রাশিয়ায় বার্ধক্য নিয়ে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ ও ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের কিছু কিছু আলোচনায় বার্ধক্য এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কথা উদ্বেগের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। ১৯৮২ সালের অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রবীণ বিষয়ক প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। উক্ত সম্মেলনে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা গৃহীত হয়।
দিকনির্দেশনায় ১৪টি মূলনীতির আলোকে প্রবীণদের কল্যাণ বিধানের লক্ষ্যে ৬২টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সভায় প্রতি বছর এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করার পর প্রবীণদের সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর যথাযথ মর্যাদায় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করা হয়।২০০২ সালে বিশ্বের ১৫৯ টি দেশের প্রতিনিধিগণের অংশগ্রহণে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে প্রবীণ বিষয়ক ২য় বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে একটি সুসংবদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয় যা ‘মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা’ হিসাবে পরিচিত। উক্ত আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন কর্তৃক অনুমোদিত হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ‘সকল বয়সীদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়- সকল প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন।
নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন। নিজেদের সমাজে স্বেচ্ছামূলক কাজ ও আয় বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীণদের ক্ষমতায়ন। জীবনব্যাপি এবং শেষ জীবনেও স্বচ্ছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রবীণরা কোনও একক সমজাতীয় বর্গ নয়-বিষয়টি স্বীকার করে তাদের জীবনব্যাপি শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ।
প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তার বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে। জেন্ডারকেন্দ্রীক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যে জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার। সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্ত:প্রজন্ম নির্ভরশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান। প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা।প্রবীণদের মধ্যে প্রাইভেট সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সব মহলের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সহযোগিতা। উন্নয়নশীল দেশসমূহে অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিকর, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলো কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান। আদিবাসী প্রবীণদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অন্যান্য পারির্পাশ্বিকতা বিবেচনায় রেখে তাদের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রকাশের সুযোগ দেয়া। এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণায় যে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়েছে তা হলো --(ক) প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন।(খ) প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি। (গ) প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। প্রবীন দিবস পালন করার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য হচ্ছে : প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি, বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির করা। প্রবীণদের দীর্ঘ জীবন, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ’ অধিকার রক্ষা ও পুণর্বাসন।
আজকে যারা যুবক তারা আগামী দিন প্রবীণ। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। মানুষের দুনিয়ার জীবন হলো জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়। অবশ্যই আমাদের আরো একটি জীবন রয়েছে যার নাম পরকালীন জীবন। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। দুনিয়ার জীবনটা হলো ক্ষণকালীন এবং পরকালীন জীবনের শষ্যক্ষেত্র। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য এই পাঁচটি স্তরে মানুষের জীবনকে ভাগ করা হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই জীবনের এক একটা স্তর অতিক্রম করে অন্য স্তরে উপনীত হতে হয়। জীবন চক্রের সর্বশেষ ধাপ বা পরিণতি হলো বার্ধক্য বা প্রবীণত্ব । মানব জীবনে বার্ধক্য হচ্ছে সবচেয়ে নাজুক ও স্পর্শকাতর অবস্থা।
শুধু বয়সের কারণে বা বার্ধ্যকের কারণে প্রবীণরা গুরুত্বহীন অবস্থায় অবমূল্যায়নের জীবন ধারণ করবেন, তা এই সচেতন ও সভ্যসমাজে হতে পারে না। তারা অবহেলায় থাকতে পারে না। আধুনিক ও নবীন সমাজ আমরা সকলে দায়বদ্ধ প্রবীণ সমাজের নিকট। প্রবীণরাই আমাদের জন্ম দিয়েছেন, তারাই আমাদের শিশুকাল, শৈশবকাল ও কৈশোরকালের লালন-পালনকারী। তাদের কারণেই আমরা পৃথিবীর আলো-বাতাসে বড় হয়েছি, আমাদের সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র এমনকি পৃথিবীটা বাসযোগ্য হয়েছে এই প্রবীণ মানুষগুলোর পরিশ্রমে, তাদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তায়। তাদের প্রতি কোন বৈষম্য নয়, কোন করুণা নয় কোন অবহেলা নয় বরং প্রদর্শন করতে হবে নৈতিক, আদর্শিক ও ধার্মিক দায়িত্ব।
একজন সক্ষম মানুষ তার জীবনের পুরোটা সময় শেষ করে দেয় যে পরিবারের জন্য, জীবনের শেষ সময়ে সেই পরিবারে থাকাটা তার নৈতিক অধিকার। আর এই অধিকার হলো আল্লাহ প্রদত্ত। এটা তাদের প্রতি কোন দয়া নয়। কোন অনুগ্রহ নয়। সুতরাং পরিবারই হচ্ছে প্রবীণদের আসল ঠিকানা। অথচ বাবা-মা প্রবীণ হয়ে গেলে আজকের সন্তানরা তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মায়ের মনের যে লুকানো আকুতি তা সন্তানরা দেখতে পায় না। এটা ভেবে দেখে না যে, সেই সন্তানরাও একদিন প্রবীণ হবে, একদিন তাদের সন্তানও একই আচরণ তাদের সাথেও করতে পারে। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত তার পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের প্রতি যত্নবান হওয়া। তাদের সু্যোগ সুবিধা ও শরীরের প্রতি খেয়াল রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব । যে বাবা সন্তানের সুখের জন্য নিজের সুখের কথা ভুলে যায় , যে মা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায় শেষে বয়সে তাদের প্রতি খেয়াল রাখা প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ। নিলয় ১৪ নতুন পাড়া সুনামগঞ্জ। ০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ sdsubrata2022@gmail.com